যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদ খলিল। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অভিযান তার জীবনের সঙ্গেও জড়িত। কারণ ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ নিজেও একজন ফিলিস্তিনি। শরণার্থী হিসেব বেড়ে উঠেছেন সিরিয়ায়। তার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, তিনিও যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তবে তার মনে একটা ভয় কাজ করছিল।
যে দোটানার মধ্যে খলিল পড়েছিলেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধারণ একটি বিষয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন এফ-১ শিক্ষার্থী ভিসায়। এই ভিসার আওতায় তিনি কত দিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারবেন, তা নির্ভর করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যত দিন তাকে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রাখবে, তত দিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা নিয়ে সমস্যায় পড়বেন না তিনি।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন, তাদের অনেককেই বহিষ্কারসহ নানারকম শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। এমন কোনো সাজা পেলে খলিলের ছাত্রত্ব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারতো। তিনি বলেন, ‘(বিক্ষোভের) শুরু থেকেই আমি মানুষ ও গণমাধ্যমের চোখের আড়ালে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বড় ঝুঁকি আছে-এমন কোনো কিছুতে নিজেকে জড়াতাম না।’
সরাসরি ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ বা ক্যাম্পাসে তাঁবু গেড়ে বসার বদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রসংগঠনের হয়ে মধ্যস্থতাকারীর কাজ শুরু করেন খলিল। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। খলিলের ভাষ্যমতে, এর বেশি কিছু করার সুযোগ তার ছিল না।
যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে থাকার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত ভিসার ওপর নির্ভর করেন, তাদের জন্য সাময়িক বহিষ্কারও গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। খলিল বলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খুব কাছে থেকে কাজ করেছেন, যেন নিজের কাজকর্মের জন্য তাকে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তার মনেও হয়েছিল যে হয়তো তিনি সাজার মুখে পড়বেন না। এরপরও গত ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়ে দেয় যে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযোগ-তিনি নাকি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। খলিল বলেন, ‘আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এটা এতটা উদ্ভট যে তারা এমন একজনকে বহিষ্কার করল, যে কিনা মধ্যস্থতার কাজ করছিল।’
আইনি বিপদ
বহিষ্কারের একদিন বাদে খলিলের কাছে একটি ই-মেইল পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তিন বাক্যের ওই মেইলে বলা হয়, বিভিন্ন নথিপত্র ও প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে তার ‘অন্তর্র্বর্তী বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে ফোন করে এই ‘ভুলের’ জন্য খলিলের কাছে ক্ষমাও চাওয়া হয়।
তবে আইনবিশেষজ্ঞ ও নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবীরা এর মধ্যেও শঙ্কা দেখছেন। তাদের ভাষ্যমতে, যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে থাকার জন্য শিক্ষাসংক্রান্ত ভিসার ওপর নির্ভর করেন, তাদের জন্য সাময়িক এই বহিষ্কারও গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির ‘ক্রিয়েটিং ল এনফোর্সমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যান্ড রেসপনসিবলিটি’ প্রকল্পের সহপ্রতিষ্ঠাতা নাজ আহমেদ বলেন, শিক্ষার্থী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা কেউ যদি তার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে আর তালিকাভুক্ত না থাকেন, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিষয়টি ২১ দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র দফতরকে (ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি) জানাতে হয়।
স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন তথ্য যাওয়ার পর ওই শিক্ষার্থীকে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হয়। আর তা না করলে ঝুঁকি থেকে যায়, কখন তাকে দেশটি থেকে বিতাড়িত করা হবে। নাজ আহমেদ বলেন, এমনটি হলে ওই শিক্ষার্থী যদি অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে আবার আবেদন করতে চান, তখন তার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা বিদেশিরাও দেশটির নাগরিকদের মতো অনেক অধিকার ভোগ করে থাকেন। যেমন বাকস্বাধীনতার কথাই বলা চলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যাট্রিয়ট আইনের মতো কিছু আইন এসব অধিকারও সীমিত করে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন হামলার পর এই আইন পাস করা হয়েছিল।
নাগরিক অধিকারবিষয়ক আইনজীবী ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এলিজাবেথ ওউইয়াংয়ের ভাষ্যমতে, প্যাট্রিয়ট আইনের মাধ্যমে বিক্ষোভ-সমাবেশকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর এমন কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত যে কারো অভিবাসনে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হয়েছে।
Recent Comments