লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ব্যাপকভাবে একজন ক্যারিশম্যাটিক এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে দেখা হয়েছিল, যিনি ব্যবসায়িক বিশ্বে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। যদিও তিনি একটি চলমান সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন-দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে কিভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়। নির্বাচনের পরে মোদি সেই একই ধাঁধার উত্তর খুঁজে চলেছেন। যদিও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে তার অবস্থান খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়। তিনি এমন একটি দলের প্রধান যেটিকে নির্বাচনে শায়েস্তা করা হয়েছে, ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তিনি জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়েছেন।
মোদির কর্তৃত্ব তার জোটের শরিকদের মধ্যে জটিলতার কারণে সীমাবদ্ধ হতে পারে। তিনি একচেটিয়া ক্ষমতা হাতে রেখেও ভারতের সবচেয়ে গভীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সমাধান করতে পারেননি। এখন তিনি একজন দুর্বল নেতা যাকে শরিকদের স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করার কোনো সুস্পষ্ট উপায় তার সামনে নেই। মোদি প্রশাসনের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান, যিনি এখন ওয়াশিংটনের পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক্সের সিনিয়র ফেলো, তিনি বলেছেন, ‘গত চার, পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের গতি দুর্বল হয়েছে। এর মধ্যে আপনি কীভাবে আরও চাকরি তৈরি করবেন? এটি সত্যিই ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, আমি মনে করি সরকারের সামনে সমাধানের বড় কোনো সুযোগ নেই।’
মোদির দলের প্রতি জনগণের হতাশা বাড়ছে। কয়েক মিলিয়ন মানুষের দেশ ভারতে বাড়ছে অর্থনৈতিক বিপদ, সেইসাথে সম্পদের বিস্ময়কর বৈপরীত্য আরো প্রকট হচ্ছে।
বড় বড় শহরগুলোতে, পাঁচতারা হোটেলগুলো তাদের নজরকাড়া স্পা নিয়ে গর্ব করে, অন্যদিকে বস্তিগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। গ্রামীণ এলাকার মানুষ অপুষ্টির সাথে লড়াই করছে। শিশুদের স্কুলে পাঠানোর অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে।
মুম্বাইয়ের একটি স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি অনুসারে, যদিও ভারতের কর্মজীবী জনসংখ্যার সংখ্যা প্রায় এক বিলিয়ন, এর মধ্যে ভারতে মাত্র ৪৩০ মিলিয়ন চাকরি রয়েছে। যাদের কর্মরত হিসাবে গণনা করা হয় তাদের বেশিরভাগই দিনমজুর এবং খামারের শ্রমিক, নির্ভরযোগ্য মজুরি এবং সরকারি কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষার অভাব হিসাবে তাদের জীবন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আটকে আছে।
উন্নত জীবনযাত্রা অনেক শহরেই স্পষ্ট। দিগন্ত ছোঁয়া উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমল এবং বিলাসবহুল গাড়িতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। দেশের দক্ষিণে এবং রাজধানী নয়াদিল্লির আশেপাশে প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোতে কাজ করা পেশাদাররা যথেষ্ট অগ্রগতি উপভোগ করেছেন। একটি দ্রুত বর্ধনশীল দেশীয় অটো শিল্প তুলনামূলকভাবে উচ্চ বেতনের চাকরির উৎস তৈরি করেছে। এশিয়ার অন্যতম ধনী ব্যক্তি গৌতম আদানির মতো বিজনেস ম্যাগনেটরা মোদির সাথে তাদের সম্পর্ক এবং ভাগ্যের জোড়ে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে নিজেদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে উন্নত করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ভারতীয় কর্মী যারা তথাকথিত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত তারা কার্যকরভাবে বিপর্যস্ত-রাস্তার ধারের স্টলে, ছোট দোকানে যারা কাজ করেন তাদের আয়ের কোনো নিশ্চয়তা বা অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদন খাতে উত্থানের গল্প আমরা জানি, কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের অভাবে ভারত সেই উত্থান থেকে বঞ্চিত। দক্ষিণ কোরিয়া, চীন থেকে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন মানুষ কারখানায় অর্জিত মজুরির মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা পেয়েছে। স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপর ফোকাস, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রতি ঘৃণা এবং বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা আমলাতন্ত্রের কারণে ভারত সেই রূপান্তরের শরিক হতে পারেনি।
অর্থনীতিবিদ সুব্রামানিয়ান বলেছেন, ‘সমগ্র উৎপাদন খাত ভারতকে বাইপাস করেছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি সেই বৃহত্তর ব্যর্থতা যা ভারতকে ক্রমাগত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।’
মোদি উৎপাদনকে জোরদার এবং রপ্তানি বাড়ানোর লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বন্দরগুলোকে সুগম করেছেন, প্রশাসনিক প্রবিধানকে সহজ করেছেন। কিছু হাই-প্রোফাইল উন্নয়ন, ভারতের বাজারে অ্যাপল আইফোনের দৃশ্যমান উপস্থিতি সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, উৎপাদন দেশের অর্থনীতির মাত্র ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এটি এক দশক আগের তুলনায় কম, যখন মোদি ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন।
শেয়ারের দাম বহুগুণ করে, বিদেশী অর্থ ভারতের স্টক মার্কেটে প্রবাহিত হয়েছে, যা মোদির ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের একটি মূল উপাদান। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের ভারতীয় কোম্পানিগুলোতে সরাসরি অর্থ দেয়ার জন্য প্ররোচিত করা- একটি ঝুঁকিপূর্ণ বাজি হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল মুসলিমদের কোণঠাসা করে সামাজিক উত্তেজনা বাড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এই নির্বাচন অতিরিক্ত বিনিয়োগকে আরও নিরুৎসাহিত করতে পারে, কারণ মোদির সম্ভবত ব্যবসা সংক্রান্ত স্থবির সংস্কারগুলো পাস করা আরও কঠিন হবে। যার মধ্যে জমি সংগ্রহ করা বা ভাড়া করা এবং শ্রমিকদের নিয়োগ সংক্রান্ত আইন সম্পৃক্ত। অর্থনৈতিক গতিশীলতার দিকে কোনও সুস্পষ্ট পথ না থাকায় এবং আরও চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, মোদি হয়তো সমর্থন জোগাড় করার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি নেবেন। তিনি সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রসারিত করতে পারেন, প্রয়োজনে সম্প্রদায়ের কাছে আরও নগদ হস্তান্তরের জন্য সরকারি কোষাগার ব্যবহার করবেন। এই ধরনের একটি পদক্ষেপ সম্ভাব্যভাবে সরকারের কর্মসূচির অগ্রগতির জন্য উপলব্ধ তহবিল হ্রাস করতে পারে- যার মধ্যে হাইওয়ে, বন্দর, বিমানবন্দর এবং অন্যান্য অবকাঠামোর নির্মাণ জড়িত। এই পরিকল্পনাগুলো ভারতের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য এবং উৎপাদনে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য বিস্তৃত প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, অর্থের বিক্ষিপ্তকরণের জেরে কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প দুর্বল হতে পারে। গ্লোবাল ডেটা টিএস লম্বার্ড-এর প্রধান ভারতীয় অর্থনীতিবিদ সুমিতা দেবেশ্বরের মতে, ‘আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাবে, মানুষ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধা না পায়, তবে এটি মূলত স্থবিরতা সৃষ্টি করে।’
ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের উৎপাদন খাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাণিজ্য শত্রুতায় জড়িত, বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলো তাদের পণ্য তৈরির জন্য চীনা কারখানার উপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। ওয়ালমার্টের মতো বড় খুচরা বিক্রেতারা চীনের বিকল্প হিসেবে ভারতকে ক্রমবর্ধমানভাবে খুঁজছে।
কিন্তু সম্ভাব্য বিনিয়োগের চাহিদাগুলোকে ধরে রাখার জন্য হাইওয়ে, রেল সংযোগ এবং বন্দরগুলোর আপগ্রেডিং অব্যাহত রাখা এবং কারখানার কাজ করার জন্য লোকেদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়াতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উপর ফোকাস করা প্রয়োজন। এমনকি নির্বাচনের আগে, সন্দেহ ছিল যে মোদির প্রশাসন এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করার জন্য যথেষ্ট দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। দেবেশ্বর বলেছেন, ‘ভূ-রাজনীতির দিক থেকে চীনের পাল্টা হিসেবে আমরা ভারতে বিনিয়োগের কিছু প্রবাহ দেখতে পাব। কিন্তু এই সুযোগগুলোর জন্য ভারত যে পদক্ষেপ করছে তা যথেষ্ট বড় মাপের নয়।’
Recent Comments