September 20, 2024
Latest news

কর্তৃত্ববাদের উত্থানে দেশে-বিদেশে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি ভারত:

ওয়াশিংটনে এসএপি প্যানেল আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক বিশেষজ্ঞরা

গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় হুমকি, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতিতে যখন উদ্বেগ বেড়েই চলছে তখন ভারতের ভোটাররা তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচনে ভোটাধিকারে অংশগ্রহণ করছেন। আর এই পরিস্থিতি দেশে এবং বিদেশে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে তা নিয়েই শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এক প্যানেল আলোচনায় নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন বিশ্লেষকরা। চলমান পরিস্থিতিতে ভারতে কী ঘটছে তা নিয়ে বিশ্লেষকরা যেমন আলোচনা করেছেন ঠিক তেমনি এই অবস্থা থেকে বেরুনোর পথ খোঁজে বের করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে চীনকে টেক্কা দিতে যদিও ভারতযুক্তরাষ্ট্র বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য করছে তবুও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ভারতে অব্যাহত  মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে মনোনিবেশ করা।

ওয়াশিংটনে ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবেসাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস ( এসএপি)’ আয়োজনে  ‘নেভিগেটিং ক্রসরোডস: ইন্ডিয়াস ইকোনমি, ডেমোক্রেসি এন্ড কোয়েস্ট ফর হিউম্যান রাইটসশীর্ষক এক প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে কূটনীতিক, লেখক, সাংবাদিক মানবাধিকার কর্মী এসব কথা বলেন।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাউথ এশিয়া   পার্সপেক্টিভস সম্পাদক উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার অ্যাম্বাসেডর  উইলিয়াম বি মাইলাম, ইউএস চীফ এগ্রিকালচারাল নেগোশিয়েটর অ্যাম্বাসেডর ইসলাম সিদ্দিকী, লেখক সলিল ত্রিপাঠি এবং মানবাধিকার কর্মী সরিতা পাণ্ডে।

প্যানেল আলোচনার দর্শকসারিতে ছিলেন কংগ্রেসের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশন, স্টেট ডিপার্টমেন্টফ্রিডম হাউস, হিন্দুস ফর হিউম্যান রাইটস, ইন্ডিয়ান আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিলের প্রতিনিধিবৃন্দ। এছাড়াও জাতিসংঘ বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ, সাবেক রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিনিধি। 

অ্যাম্বাসেডর উইলিয়াম বি মাইলাম বলেন, “নির্বাচন যেভাবেই হোক তার একটা প্রভাব তৈরি হয়। ভারতের নির্বাচন কী পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে সেটা দেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ধীরে হলেও ভারত কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভাবা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা বিভিন্ন দেশে যেভাবে অপ্রপচার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেদিকে তারা যেন বিশেষ মনযোগ দেন। মাইলাম মনে করেন গণতন্ত্র বিরোধী এসব অপপ্রচার খুব বেশী করে চালানো হচ্ছে এবং চরমভাবে তা কার্যকর করা হচ্ছে।

মাইলাম বলেন, “কর্তৃত্ববাদ সংক্রান্ত অপপ্রচারের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০৩০ বছরের ব্যবধানে এরকম কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন বিরোধী উত্থানের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন মাইলাম।

ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তৈরি করা গল্প, বানােয়াট তথ্য এবং এগুলোর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে লেখক সলিল ত্রিপাঠি বলেন, “সুন্দর সুন্দর শপিং মল আর বিমানবন্দর নিয়ে বড় বড় গল্প করছে মানুষ। আমার দুশ্চিন্তা তখনি বেড়ে গেল যখন দেখলাম এশিয়ার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর সুন্দর ঐসব অবকাঠামাগুলোতে ভূতুড়ে নীরবতা। এই পরিস্থিতিতে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিটা হয় বিপদজনকভাবে। কারণ সময়টাতে আপনি যখন সত্যিকারের জটিল ইস্যুগুলো নিয়ন্ত্রণ এবং মোকাবিলা করতে পারেননা তখন আপনি সংখ্যাগরিষ্ট এবং ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যে মনে হচ্ছে সাজাটা তাদের প্রাপ্য। এই পরিস্থিতির যারা ভুক্তভোগী তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু বলে গণ্য করা হয়।

তিনি বলেন, “এটা খুব পরিতাপের বিষয় যে, ভারতের ৮০ শতাংশ যুবক বেকার। মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী হাজার হাজার শিক্ষার্থী চাকরির অভাবে নিম্ন পর্যায়ের চাকুরির প্রত্যাশায় আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছে।

ভারতের স্বজনতোষী পুঁজিবাদ প্রসঙ্গে সলিল বলেন, “ভারতে আপনি যদি বিদেশী কোনো বিনিয়োগকারী হন আর আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী যদি হন আম্বানি এবং আদানির মতো কেউ তাহলে হয় আপনাকে দেশটিতে ব্যবসা বিক্রি করে দিতে হবে নতুবা তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।

অর্থনৈতিক অসমতা এবং বৈষম্য প্রসঙ্গে সলিল গুজরাটের কিছু মুসলমানদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন যারা বলেছে যে, তারা ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা বাদ দিয়েছে। সলিল বলেন, “তারা ন্যায় বিচারের আশা করেনা। তারা এখন নিজেদের সামর্থ বাড়াতে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার এবং হিসাবরক্ষকের মতো পেশায় মন দিয়েছে। কারণ তাদের কেউ চাকরি দিতে চায়না। সিভিতে তাদের নাম দেখে সাক্ষাতকারের জন্য কেউ ডাকেনা।

সলিল মনে করেন ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টি ফাঁকা বুলি। তিনি মনে করেন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট এবং প্রভাবশালীরা তাদের এই দুর্ভোগের বিষয়টি বুঝতে শুরু করেছে।

সলিল বলেন, “নির্যাতিত এসব মানুষ এবং সংখ্যালঘুরা যেন রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।

অ্যাম্বাসেডর ইসলাম সিদ্দিকী অতীত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবিস্তারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। তিনি ভারতের সাংবিধানিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, “ভারতে গণতন্ত্রের বাজে এবং গণ্ডগোলের চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি যদিও মাঝে মাঝে নির্বাচিত নেতারা দেশটির সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি সবসময় তাদের আনুগত্যের কথা বলে থাকে। প্রতিশ্রুতির বিষয়টাই মূলত ভারতের গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত করে।

প্রধানমন্ত্রী মোদি তার জনসমর্থন বাড়াতে ধর্মীয় বিভাজনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছেন বলে মনে করেন অ্যাম্বাসেডর ইসলাম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “মনিপুরে সহিংসতায় ৬৫,০০০ খ্রিস্টান গৃহহীন এবং ২৫০ টি চার্চ পুড়িয়ে দেবার পরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি প্রধানমন্ত্রী  মোদি। ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে মনিপুর সংকট নিয়ে কথা বলেন মোদি।

তিনি বলেন, “ভারতে যা ঘটছে তা জানে বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু ভূরাজনৈতিক কারণে এবং চীনকে মোকাবিলায় আপাতত অনেক বিষয়ে কথা বলছেনা যুক্তরাষ্ট্র।

ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ঘাটতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী সরিতা পাণ্ডে। তিনি বলেন, “বিগত ১০ বছরের বেশী সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রশাসনের বিভিন্ন মন্ত্রী এবং নেতাদের দুর্নীতি, প্রতারণা, অনিয়ম এবং সন্ত্রাস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো  রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারছেনা প্রধান সারির গণমাধ্যমগুলো। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হামলা এবং খুনের মতো অভিযোগ রয়েছে। দুই মাসে আগে একটা তথ্য ফাঁস হয়েছে যাতে বলা হয়েছে, গোপন কাজে ব্যবহার করার জন্য মোদির দল অন্তত এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে। গণমাধ্যমগুলো মোদিকে প্রশ্ন করার বদলে উল্টো সুরক্ষা দেবার জন্য ওভারটাইম ডিউটি করছে।

গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সরিতা পাণ্ডে গুজরাটে গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে তেহেলকা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রিপোর্টের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “তখনকার সময়ে গুজরাটে মোদির ঘনিষ্ট সহযোগী, যিনি বর্তমানে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অমিত শাহকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো এবং তার বিচার চলমান ছিলো। মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পরই মামলার বিচারককে দ্রুত বদলি করে দেওয়া হয়। পরবর্তী বিচারক মামলা বাতিল করে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তার ফলস্বরুপ এক সপ্তাহের মধ্যেই বিচারকের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। তৃতীয় বিচারক এই মামলার দায়িত্ব নেবার পর তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে অমিত শাহকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেন। আর এর কারণ ব্যাখ্যা না করে এই বিচারক বলেন, রাজনৈতিক কারণে ভুল করে মামলায় অমিত শাহকে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো।

রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার্স এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের প্রকাশিত রিপোর্টগুলোর তথ্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে সরিতা পাণ্ডে বলেন, “সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি দেশে পরিণত হয়েছে ভারত।

আলোচনায় মডারেটরের দায়িত্ব পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন কূটনীতির  এবং সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস এডিটর এ্যাট লার্জ জন এফ ড্যানিলোয়িচ এবং আগত অতিথিদের স্বাগত জানান সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস   নির্বাহী সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারী।

Youtube

বিভাগসমূহ

Recent Comments
Scroll to Top
September 20, 2024

Editor & Publisher : Dr. Kanak Sarwar

© Copyright 2019-2024 Rajnity. All Rights Reserved