ফ্রিডম হাউসের কলাম
বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার নাটকীয় অধ:পতনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অনুপ্রবেশকারীদের মতো বিরোধী দল, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়েছে। সুশীল সমাজের নীতি নির্ধারকদের উচিত নতুন করে এক হয়ে নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউসের এক কলামে এই মন্তব্য করা হয়েছে। কলামটি লিখেছেন সংস্থাটির এশিয়া প্রোগ্রামসের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার নায়লা রফিক।https://freedomhouse.org/article/fighting-back-against-awami-leagues-clampdown-democratic-space?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR0EmEpDM6NeOXjgHrY0amBzA2Z1FUszy60ns_W22L6SyPuFdf51BKYNVjI_aem_AdrGqF75QC_gdS9nBspF9VyjOY5mPhfD3ybC5f5rUo8HD2t5SfNBXgGtU2w_eJGA5tIIRwjYFIIrKQ6Y336nm9nM
পাঠকদের জন্য কলামটির অনুবাদ নীচে তুলে ধরা হলো:
বিগত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং নাগরিক স্বাধীনতার নাটকীয় অধ:পতনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ। জনগণের প্রতিদিনের জীবন যাত্রায় ঠিক অনুপ্রবেশকারীদের মতো করে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিরোধী দল, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়েছে, পশ্চাদপদ আইন জারি করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে এবং অভ্যাসগতভাবে সরকার বিরোধী সমাবেশের বাধাগ্রস্থ করতে গলা চেপে ধরার মতো করে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। এসব নির্যাতনের ঘটনার কারণে ২০১৪ সাল থেকে ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়াল্ড’ এবং ‘ফ্রিডম ইন দ্য নেট’ এই দুই সূচকেই অন্তত ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
এই নির্যাতনমূলক পরিবেশের মধ্যেই ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় এসেছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনে কারচুপির ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন কায়দায় তার সমালোচকদের ওপর আক্রমণের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়েছে। আর এ কারণে দেশটির দৃশ্যমান ভঙ্গুর গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হচ্ছে এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাজ করার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আরও ৫ বছর মেয়াদে কীভাবে কার্যকর পরিবর্তন আনা যায় সে বিষয়ে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তিন জায়গায় বাংলাদেশের মানবাধিকার আর আইনের শাসনের দ্রুত অবনতি ঘটছে এবং এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ খোঁজা দরকার।
ভয় এবং সেল্ফ সেন্সরশীপের সংস্কৃতি
বাংলাদেশে সাইবার সিকিউরিটি আইন জারি করে খুব বাজেভাবে অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। এছাড়া কালাকানুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারিমূলক অনেক আইন এতে পুনরায় যোগ করা হয়েছে। সরকারের সমালোচনা হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে বিগত বছরগুলোতে হাজার হাজার মানুষকে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই আইনগুলোর মাধ্যমে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিক এবং লেখকসহ প্রায় ৪,০০০ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের ৪০ শতাংশ বিরোধী দল বিএনপি সমর্থিত সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতি অস্ত্রের অপব্যবহার নিয়ে ফ্যাক্ট বেইজড রিপোর্ট প্রকাশ করার জেরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের চরম উত্তেজনাকর নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতিতে ডিএসএ এবং সিএসএ আইন দুটি জারি করা হয়েছিলো। দুটি আইন জারি করার সময় দেখা গেছে যে, প্রতিশোধ এড়াতে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং অন্যরা এসব আইনের ভয়ে সেল্ফ সেন্সরশীপ আরোপ করেছে। এই প্রতিষ্ঠিত ভয়ের সংস্কৃতির কারণেই ২০২৪ সালে মুক্ত রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ খর্ব করেছে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুসারে সরকার চাইলেই অনলাইনের যেকোনো কন্টেন্ট অপসারণ বা বন্ধ করে দিতে পারে। গণমাধ্যমগুলোকে অব্যাহতভাবে সেল্ফ সেন্সরশীপ আরোপে বাধ্য করা হচ্ছে এবং নিউজ ওয়েবসাইট থেকে রিপোর্ট সরাতে বাধ্য করছে সরকার।
দেশের বাইরে নির্যাতন
মানবাধিকার কর্মীদের নির্যাতনে দেশের বাইরে বিদেশেও তাদের হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন করছে সরকার। আন্ত:দেশীয় নির্যাতনের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সরকারের কর্মকর্তারা বিদেশে অবস্থানরত সরকারের সমালোচকদের নির্যাতন করতে সহিংসতা এবং হয়রানিমূলক আচরণ করছে। শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে কেউ যেন রাষ্ট্র বিরোধী প্রচারণা চালাতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে বিদেশে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূতদের ২০২৩ সালের জুলাই মাসে নির্দেশনা দেন। দেশের বাইরে সমালোচকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপব্যবহার করছে সরকার। ফ্রিডম হাউসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ হলো ৩৮ দেশের মধ্যে একটি যে দেশ আন্ত:দেশীয় নির্যাতনের শিকারী দেশ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থাগুলোকে টার্গেট করা
নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কৌশলে বিভিন্ন এনজিও এর প্রভাব কমাতে এবং কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করতে বাংলাদেশ এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো প্রজেক্টের অনুমোদন এবং ফান্ডিং বন্ধ করে দিয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিও অভিযোগ করেছে যে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে তাদের ওপর নজরদারি করছে। প্রজেক্ট রেজিস্ট্রেশন বিলম্বিত করা, জব্দ করার চিঠি ইস্যু করা এবং ভিসা না দেওয়া–এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে সরকার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশাসনিক কাজ এবং মানবাধিকার ইস্যুতে এনজিওগুলোর ফান্ড আটকে রেখেছে ব্যাংক। এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নিজেদের কাজের পরিধি সীমিত করে নিয়েছে অনেক স্থানীয় এনজিও। আর এর প্রভাব পড়ছে এনজিওগুলোতে দাতারা অর্থায়নে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন যে, জনসম্মুখে ক্ষমতাসীন দলের নীতির সমালোচনা করায় গ্রেফতারের হুমকি পাচ্ছেন।
এনজিওগুলোর ওপর এই দমনের কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং শাসন ব্যবস্থা নিয়ে জাতীয়ভাবে যেসব আলোচনার দরকার সে ক্ষেত্রে চরম অবনতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এর ফলে দেশটিতে কী ঘটছে তা জানার সুযোগ পাচ্ছেনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এই ধারাবাহিকতার রেশ ধরে দেশটিতে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের জায়গাগুলো কীভাবে কাজ করা হচ্ছে এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব পরামর্শ দিয়েছে তা কার্যকর হচ্ছৈ কীনা সে বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
ভবিষ্যতে যে পরিকল্পনা নেয়া যায়
সুস্থ গণতন্ত্র এবং সরকারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে অংশীদারদের উচিত তাদের ক্ষমতা দিয়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে করে সরকার পুনরায় সংস্কারে বাধ্য হয় এবং অধিকতর স্বচ্ছতার সঙ্গে মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে কাজ করে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ সরকারকে সিএসএ এর বিতর্কিত ধারাগুলো সংস্কার করতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, দেশের জারি করা আইন যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির যেসব প্রতিশ্রুতি রয়েছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
অন্তবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে যেসব মামলার বিচার এখনো বাকি রয়েছে সেগুলোর দ্রুত, স্বচ্ছ এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচারের ব্যবস্থা করে দেশটির কর্মকর্তাদের উচিত আস্থা ফিরিয়ে আনা। আর এর জন্য তাদেরকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। এটা না করা হলে বাংলাদেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর তাদের আস্থা হারাবে এবং এর ফলে রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জবাবদিহিহীনতার অধিকতর স্বাধীনতা পেয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, সুশীল সমাজের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদেরকে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং সংস্কারে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এনে স্বচ্ছতা, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা, উদারতা, রাজতন্ত্র থেকে বের হয়ে নেতৃত্বে ভিন্ন চিন্তার সুযোগ করে দিতে হবে। এটা করতে পারলে তাদের সমর্থন বাড়বে, আন্তর্জাতিক শাস্তি এবং চাপ কমবে, নতুন মেয়াদে যে পরিবেশ তৈরির দরকার তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে এবং এমনকি ভিন্নমতের নাগরিকদের নিজেদের সমর্থনের জন্য আকৃষ্ট করতে পারবে। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিসরে কথা ভাবা উচিত।
আরও স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের জন্য সুশীল সমাজের উচিত সরকারকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা এবং আন্তর্জাতিক সেরা কার্যক্রমের বিষয় উপস্থাপন করা। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সিএসএ এর সংস্কার, নতুন এবং বৃহৎ পরিসরের পদক্ষেপের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার ন্যায্যতা এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের বাজে আচরণের আশংকা ছাড়াই তাদেরকে এ কাজে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে হবে।
শেষ কথা হচ্ছে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের দাবি এবং অনুসন্ধানের বিষয়ে অধিকতর পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। উদাহরণ হিসাবে বলতে হয়, যখন কোন দেশ ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্টের অধীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চায় তখন সে দেশের উচিত বর্তমান নেতৃত্বসহ এমন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করা যারা স্পষ্টভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এর বাইরে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং কর্মীদের ওপর সরকারের নির্যাতনের বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি এবং রিপোর্ট প্রকাশ অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে থাকতে হবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা। এ ধরনের পদক্ষেপসমূহে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রভাবিত হবে কীনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকার পরও, বিশেষ করে তাদের পিছনে ভারত এবং চীন সরকারের অব্যাহত সমর্থন রয়েছে, এসব যাই থাকুক না কেন পদক্ষেপসমূহ হলো গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
একদিকে, নির্বাচন যেমন অনিশ্চয়তার এক পরিবেশ তৈরি করেছে অন্যদিকে, এটি পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগও সামনে এনেছে। সরকারের উচিত ক্রমাগত সংস্কার পদক্ষেপে মনযোগ দেওয়া এবং সুশীল সমাজের নীতি নির্ধারকদের উচিত নতুন করে এক হয়ে নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
Recent Comments