আগামী জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশে নব্য রাজতন্ত্রের উত্থান হতে পারে এবং শেখ হাসিনা স্বৈরশাসকে পরিণত হবার শঙ্কা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারভিত্তিক এক রিপোর্টে এই শঙ্কার বিষয়টি উঠে এসেছে। ম্যাগাজিনটির নভেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ করা হয়েছে শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে। আর শিরোনামে লেখা হয়েছে “হার্ড পাওয়ার: প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা এন্ড দ্য ফেইট অফ ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ।”
রিপোর্টে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
এছাড়া, অসুস্থ সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংকটাপন্ন অবস্থায় গৃহবন্দি হিসেবে আটক রয়েছেন।
চার্লি ক্যাম্পবেল গত সেপ্টেম্বর মাসে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেন। তার এই সাক্ষাৎকারকে ভিত্তি করে তৈরি করা রিপোর্টে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতান্ত্রিকতা, বেগম খালেদা জিয়ার গৃহবন্দিত্ব, বিরোধীদলকে নিপীড়ন, সরকারের আজ্ঞাবহ ভঙ্গুর বিচারব্যবস্থা এবং বাকশাল শাসনসহ বাংলাদেশের নানা বিষয়ের আলোচনা উঠে এসেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগেই ব্যালট বক্স ভর্তি করা এবং হাজার হাজার ভুয়া ভোটার দেখানোসহ ব্যাপক অনিয়মের কারণে শেষ দুই জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য অংশীদার দেশগুলো।
বিরোধীদলের ওপর সরকারের নিপীড়ন প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় সংকটাপন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গৃহবন্দি হিসেবে আটক রয়েছেন। প্রশ্নবিদ্ধ অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, দুঃখজনক বিষয় হল- ৪০ লাখ মামলা দিয়ে বিএনপি কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে। স্বাধীন সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হয়রানির অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের পথে হাঁটার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন।যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ দুটি গণতন্ত্র সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানায়নি দেশটি। গত মে মাসে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী যেকোনো বাংলাদেশিকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাকে ষড়যন্ত্র করে সরিয়ে দিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়।”
ভঙ্গুর বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যাদেরকে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য শত্রু মনে করা হয় তারা যেকোনো ধরনের তুচ্ছ সমালোচনা করলেও একের পর এক আদালতের টার্গেট বানানো হচ্ছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ত্রুটিপূর্ণ মামলায় দুই বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মীকে ২ বছরের জেল দেয় আদালত। এ রায়ের তীব্র নিন্দা জানায় বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট এবং ছাত্ররাও আদালতের টার্গেট বানানো হচ্ছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশিদের জীবন যাত্রায় বন্যা যেভাবে প্রভাব ফেলে ঠিক তেমনি দেশটির রাজনীতি সহিংসতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গত অর্ধশতক ধরে দুই পরিবারের দুই নেত্রী দেশ শাসন করে আসছে। এই দুই জনের মধ্যে তিক্ত বৈরি সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি চিত্তাকর্ষক উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতির চিত্তাকর্ষক উন্নতি হয়েছে। নিজেদের খাদ্য সংকট দূর করে বাংলাদেশ এখন খাদ্য রপ্তানি করছে। দেশটির জিডিপ ২০০৬ সালে ছিলো ৭১ বিলিয়ন ডলার। এটি ২০২২ সালে ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সামাজিক সূচকেও উন্নতি হয়েছে। দেশটির ৯৮ শতাংশ মেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করছে। উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পের বিকাশেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্যামসাং এর মতো প্রতিষ্ঠানকে চীন থেকে দেশে প্রযুক্তি পণ্যের সরবরাহ নিয়ে আসার অনুমতি দিয়েছে।
অন্যদিকে, উন্নয়ন নিয়ে শেখ হাসিনার অতিকথন প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা বার বার বলে বেড়ান যে– খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং চাকুরির ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ তৈরি করেছেন। আমি এটা করেছি, ওটা করেছি।–কিন্তু বাস্তব কথা হল, তিনি যেমনটা বলছেন বিষয়টা একেবারেই তেমন সহজ না। ফ্রিডম হাউস রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে আংশিক স্বাধীনতা রয়েছে। দেশটির অর্থনীতি এখনো কৃষি, সস্তায় তৈরি পোশাক রপ্তানি এবং প্রতি বছর প্রবাসীদের পাঠানো প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এর ওপর নির্ভরশীল।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিগত চার দশকেরও বেশী সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব বেশী একটা পরবির্তন হয়নি। আজকের দিনেও বিরোধীদল অভিযোগ করছে যে, গ্রেফতার, হামলা এবং মামলার ভয়ে তারা রাজপথে নিজেদের মত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেনা।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের গণতন্ত্রের প্রচারণার ক্ষেত্রে ‘টেস্ট কেইস’ হিসেবে দেখছে উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের প্রতিটি পদক্ষেপে বাগড়া দেয়ার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রশাসনের আগ্রাসী নীতি সে বিষয়টিই জানান দিচ্ছে। উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক মাইকেল কুগ্যালমেন বলেছেন, বাইরের দেশে নিজেদের গণতন্ত্রের প্রচারণায় বাংলাদেশকে ‘টেস্ট কেইস’ হিসেবে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে বড় ঝুঁকিটা হচ্ছে, (বাংলাদেশ) সরকারকে যেসব চাপ দেওয়া হচ্ছে তাতে উল্টোটাও হতে পারে। দেখা যাবে সরকার তার ক্ষমতায় থাকার তৎপরতা দ্বিগুণ করেছে এবং ক্ষমতায় থাকতে যা করার দরকার তাই করার চেষ্টা করবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরোধকে মানসিক অসুস্থতা উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ১৭০ জনের বেশী বিশ্বনেতা, যাদের মধ্যে নোবেল বিজয়ীরা রয়েছেন, হাসিনার কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধ বিচারিক হয়রানি বন্ধের আহবান জানিয়েছেন। শ্রম আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং টাকা পাচারসহ ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৭৪ টি মামলা দায়ের করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। হাসিনা তাকে ব্যঙ্গ করে রক্তচোষা বলে থাকেন। এটা এক অদ্ভুত রকমের প্রতিশোধপরায়ণতা। মামলার অভিযোগগুলো মানসিক অসুস্থতার কারণে তৈরি তিক্ততার প্রতিফলন।
সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের বাইরে অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা বলা প্রসঙ্গে রিপোর্টে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক বলেন, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের নতুন কালাকানুন নিয়ে প্রশ্ন করলে হাসিনা আবার এটার পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, যখনি আপনি কিছু করবেন তখন কিছু লোক এটার বিরোধীতা করবে।
ওই প্রতিবেদক বলেন, আমাদের আলোচনার সময় উদ্বেগের বিষয় নিয়ে কথা বলতেই তাৎক্ষণিকভাবে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে যেখানে পর্যালোচনা করার সুযোগ ছিলো সেখানে বিষয়টির দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরাতে পরিবারের বেদনা নিয়ে তলাবিহীন কুয়োর মতো কাহিনী বলা শুরু করেন। আমাদের ২ ঘন্টার আলোচনার সময়টাতে হাসিনা অপ্রয়োজনীয়ভাবে অসংখ্য বার তার বাবার খুনের প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে আসেন।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক রিপোর্টে বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, “বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্যই আমি কাজ করে যাচ্ছি।” কিন্তু সেই স্বপ্নটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার কোনো স্বপ্ন ছিলো না। বিদ্রোহী কিছু সেনা সদস্যদের হাতে খুন হবার প্রায় ছয় মাস আগে, ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব সমস্ত রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন এবং বাকশাল গঠন করে নিজেকে একদলীয় রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন, জাতি ছিল দৃশ্যত জরুরি অবস্থার মধ্যে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আদৌ গণতন্ত্র ফিরে আসবে কী না সেটা নিয়ে দ্বিধা বিভক্তি রয়েছে। সমালোচকরা ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার শাসনকে দ্বিতীয় বাকশাল বলে অভিহিত করেছেন।
রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য বলেন, “আমি এবং আমার বোন ৬ বছর দেশের বাইরে শরণার্থী হিসেবে ছিলাম। শরণার্থীদের দুঃখ এবং কষ্ট আমি বুঝি।” এসব কথা বললেও হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের শিক্ষা এবং জীবিকা উপার্জনের সুযোগ দেবার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবির বিষয়ে শুনেও না শোনার ভান করেছে। রোহিঙ্গাদের সরকার যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিলো সেই মনোভাব এখন আর নেই। হাসিনা বলেন, “এটা এখন আমাদের জন্য বড় বোঝা।” তিনি বলেন, “জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা যারা রোহিঙ্গাদের এখানে সাহায্য করছেন তারা একই কাজ মিয়ানমারে করতে পারেন।”
Recent Comments