Latest news

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, আটক, নির্যাতন এবং সভা সমাবেশে বাধা প্রদান অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার

যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশ

বাংলাদেশে সরকার এবং তার আইনশৃৃ্ঙ্খলাবাহিনী স্বৈরতান্ত্রিকভাবে অসংখ্য বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। সরকার তার আইনশৃঙ্খলবাহিনীর দ্বারা সংগঠিত কোনো হত্যাকান্ডের সঠিক তথ্য প্রকাশ করেনি এবং নিশিত করেনি এগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত।

সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে এ কথা বলা হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব গেল ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবার এর ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিন বার্কলে।

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এক ভয়বাহ চিত্র উঠে এসেছে। ক্রমাগত মানবাধিকার লংঘন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতামুক্ত রাখা, গণমাধ্যম দলন, বিরোধীদলকে সমাবেশ কর্মসূচিতে বাধা, রাজনৈতিক মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটক রাখা, সুশীল সমাজ এবং প্রবাসে থাকা সরকার সমালোচকদের ওপর সরকারের ক্রমাগত নিপীড়নসহ নানান বিষয় সবিস্তারে উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি প্রসঙ্গে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি। ওই নির্বাচনে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরানো এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটায় পর্যবেক্ষকেরা এ ধারণা পোষণ করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির কথা রয়েছে; যেখানে অধিকাংশ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও তার দল পাঁচ বছর মেয়াদে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন। বিভিন্ন অনিয়মের খবরে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে সুষ্ঠু ও অবাধ বলে বিবেচিত হয়নি।

শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারের বাধা দানের কথা উল্লেখ করে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারের কথা থাকলেও সরকার সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশ করার ব্যাপারে বাধা অব্যাহত রেখেছে। এবং সমাবেশের অনুমতির জন্য অহেতুক শর্ত জুড়ে দিচ্ছে সরকার। প্রায় সময়ই পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠগুলোর বিক্ষোভ ভন্ডুল করে দিচ্ছে।

পুলিশের দ্বারা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার যেসব তদন্ত করা হয় তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মানাবিধকার সংস্থাগুলো। তারা বলছে বাংলাদেশের নাগরিকেরা তাদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রতিবদেনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দ্বারা এখনো গুম, অপহরণ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের সরকারকে এসব বন্ধ করা, তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে খুব কমই পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৬ জনকে গুম করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি মানবাধিকার সংস্থা।

সুশীল সমাজ বলেছে, যাদেরকেই গুম করা হয়েছে তারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতের অধিকারী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটসসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এক খোলা চিঠিতে দাবি করে যে ২০২১ সালে র‍্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেবার পরও সরকার গুম করা অব্যাহত রেখেছে। গুমের শিকার পরিবারের সদস্যরা যেন কোনো কথা না বলে সেজন্য তাদেরকে ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের র‍্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সর্বত্র দায়হীনতা এক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে জানিয়েছে সুশীল সমাজ, মানবাধিকার কর্মী এবং গণমাধ্যমগুলো। সন্ত্রাস আর দুর্নীতির রাজনীতিকরণ, জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির কারণে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দায়মুক্তির ঘটনা ঘটছে। সুশীল সমাজ বলছে, যেখানে চরম মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা নিয়ে পুলিশের তদন্ত করার কথা তারা তা করছে না। কারণ স্বাধীনভাবে তদন্তের সুযোগ তাদের নেই। আর ভুক্তভোগীরা তাদের ন্যায় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

২০২২ সালের ২৬ জুন পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেয় স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার রাষ্ট্রীয় মদদে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে বলে বিবৃতিতে প্রতিবাদ জানায় সংস্থাগুলো।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে দায়ের করা এক মামলায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের জেল দেয়া হয়। মামলার রায়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে বলে মত দিয়েছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা। বিরোধী দলের নেতাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে এটা একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে তারা উল্লেখ করেছেন। এই আইন বিশেষজ্ঞরা এও বলেছেন যে, খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেছে আদালত।

দেশের বাইরে প্রবাসে থাকা সমালোচকদেরকেও সরকার নির্যাতন করছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বাইরে যারা থাকে তাদের ভয় দেখানো কিংবা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার কৌশলও অবলম্বন করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে- বিরোধী দলের কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিক।

এতে বলা হয়, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং প্রবাসে থাকা সরকার সমালোচকদের যেসব পরিবারের সদস্য দেশে থাকে তাদেরকে পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা নিয়মিত হয়রানি করছে এবং নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে সাংবাদিক কনক সারওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে ১৬০ দিন জেলে আটক রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, কনক সারওয়ার বলেছেন, অনলাইনে সরকারের সমালোচনায় তাকে শাস্তি দিতে এ কাজটা করা হয়েছে। তার বোনের কোনো দোষ নেই। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগ এনে ২০২০ সালে কনক সারওয়ারের ওয়েবসাইট বন্ধ করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।

প্রবাসে থাকা সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী এবং দেশে অবস্থান করা তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক হয়রানির চিত্র তুলে ধরে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডন ভিত্তিক সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটন  সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এবং ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বৃটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করার প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশে তার ভাই নূর আলম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রবাসে থাকা সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী এবং দেশে অবস্থান করা তাদের পরিবারের সদস্যদের হয়রানির চিত্র তুলে ধরে মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডন ভিত্তিক সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটন  সরকারের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এবং ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে বৃটিশ পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভের আয়োজন করার প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশে তার ভাই নূর আলম চৌধুরীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। 

দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগ এনে একই বছরের নভেম্বর মাসে ফ্রান্সে অবস্থান করা মানবাধিকার কর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মুশফিকুল ফজল আনসারীর বিরুদ্ধে ঢাকায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করে পুলিশ। 

সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিরোধী মতের লোকদের তালিকা তৈরি এবং তা বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টার্গেট করা লোকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছে সরকার। এর বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে। গণমাধ্যমের দেয়া খবর অনুসারে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্র বিরোধী কার্যক্রমে জড়িতদের একটি তালিকা বানিয়ে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো দূতাবাসগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তালিকাভুক্ত লোকদের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে চাপ তৈরি করে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন কিংবা মুক্তমত দুই ক্ষেত্রেই বড় ধরনের বাধা রয়েছে। হয়রানি এবং প্রতিশোধের ভয়ে গণমাধ্যম এবং ব্লগ কর্মীরা সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে সেল্ফ সেন্সরশীপ নীতি অবলম্বন করেছে।

এতে বলা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে সরকার এবং তার ক্ষমতাসীন দল সাংবাদিককে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। 

Youtube

বিভাগসমূহ

Recent Comments
Scroll to Top
[date-today]

Editor & Publisher : Dr. Kanak Sarwar

© Copyright 2019-2025 Rajnity. All Rights Reserved